Nurul Amin

আত্ন বিশ্বাসহীন সমাজে মৌলবাদের উত্থান।

বিশ্বজুড়ে করোনার প্রকোপ পুঁজিবাদকে কাবু করেনি, কাবু করেছে মানুষকে। পুঁজির মালিকরা এই সুযোগে ভালো মুনাফা করে নিয়েছেন। আবার করোনাকালেই তো বোঝা গেল অত্যাশ্চর্য উন্নতি ও উদ্ভাবনের ভেতরে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা কতটা নাজুক। গরিব দেশে তো অবশ্যই, ধনী দেশেও। এবং এরই ভেতর পুঁজিবাদ-সৃষ্ট পুরাতন উৎপাতগুলো নবীন উৎসাহে খলবল করে উঠেছে। যেমন : ধর্মীয় মৌলবাদ। ইসরায়েলের উন্নতি তো চমকপ্রদই। করোনাকালে তারা গ্রহণ-সক্ষম সব নাগরিককে টিকা দিয়ে ফেলেছে। তাদের গোয়েন্দারা পৃথিবীর সর্বত্র তৎপর ও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের অভ্যন্তরে গিয়ে অনায়াসে হানা দিচ্ছে, হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। কিন্তু এরই মধ্যে দেখা গিয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদী ওই রাষ্ট্রে একটি ধর্মীয় সমাবেশে ৪৪ জন মানুষ পদদলিত হয়ে মারা গেছেন, যে-ঘটনার কথা আমরা একটু আগে উল্লেখ করেছি। হামাসের রকেট হামলায় একজন নাগরিক মারা গেলে যেখানে বোমারু বিমান উড়িয়ে বিশ/ত্রিশজনকে মেরে ফেলে, তবুও শান্ত হয় না, সেখানে নিজেরাই নিজেদের ৪৪ জনকে হত্যা করে ফেলেছে। সংবাদটি যখন পাওয়া গেল তখনই অনুমান করা গেছে ফ্যাসিবাদী ওই রাষ্ট্র আরও কিছু ঘটাবে। ঘরে যে হিংস্র, বাইরে কি সে শান্ত থাকবে? ঠিক তাই! চড়াও হয়েছে গিয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর। উদ্দেশ্য জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় উন্মাদনাকে জাগিয়ে তুলে সম্প্রসারণ বৃদ্ধি করা। এরই মধ্যে জেরুজালেমকে তারা নিজেদের রাজধানী ঘোষণা করেছে, সেখানে ফিলিস্তিনিদের যে ঘরবাড়ি সেগুলো ভেঙে নগরীর উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। ফিলিস্তিনিরা বাধা দিতে গিয়েছিল। সেই প্রতিবাদকে অজুহাত করে রবার বুলেট নিক্ষেপ করে ৯ জনকে হত্যা ও ৩০০ জনকে আহত করেছে প্রথম চোটেই। প্রতিক্রিয়ায় হামাস কিছু রকেট নিক্ষেপ করেছে, যেমনটা তারা করে থাকে। আর কথা নেই, বোমারু বিমান ঢুকে গেছে। ২৫৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল। যাদের ৬৬ জনই শিশু। ঘরবাড়ি ছেড়ে যেকোনো আশ্রয়ের খোঁজে ছোটাছুটি করছেন হাজার হাজার মানুষ। অন্যদিকে রকেটের আঘাতে ইসরায়েলে প্রাণ হারিয়েছেন দুই শিশুসহ ১২ জন। দুর্নীতির মামলায়-কাবু প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন প্রতিক্রিয়াকে কঠিন হস্তে দমন করা হবে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আরব রাষ্ট্রগুলো দাঁড়াবে বলে এতকাল আশা করা হতো; সে-আশা এখন মরে গেছে; অনেক কটি রাষ্ট্র এরই মধ্যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলেছে, অন্যরাও আগ্রহী। তাদের সবার হয়ে সৌদি আরবের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘এতে সুবিধা হবে’। অবশ্যই হবে। তবে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের নয়, পীড়নকারী ইসরায়েলেরই। আর হবে ওই মুসলিম স্বৈরশাসকদের।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের যে লড়াই এটি আদতেই কোনো ধর্মযুদ্ধ নয়; এটি হচ্ছে দখলদারদের বিরুদ্ধে উৎপাটিতদের প্রতিরোধ। ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় উপেনের জমি যে দখল করে নেয় ধর্মপরিচয়ে সে ব্যক্তিও উপেনের মতোই একজন হিন্দু ছিল, কিন্তু দখলদার হিসেবে ব্যক্তিটির ধর্মীয় পরিচয় নয় জমিদার পরিচয়টিই ছিল একমাত্র সত্য। ফিলিস্তিনিরা মার খাচ্ছেন মুসলমান হিসেবে নয়, দুর্বল জনগোষ্ঠী হিসেবেই। এটি ধর্মযুদ্ধ হলে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান রাজা-বাদশাহ ও শাসকদের ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা ছিল। সেটা তারা করেনি। সাড়াই দিচ্ছে না। প্রতিরোধ সংগ্রামে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নিরন্তর যিনি লিখেছেন ও বক্তৃতা করেছেন, বিশ্ববাসীকে সমস্যাটির বিষয়ে জানিয়েছেন, তিনি হচ্ছেন এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ (১৯৩৫-২০০৩); ধর্মপরিচয়ে তিনি ছিলেন খ্রিস্টান। আর সশস্ত্র প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিয়েছেন যারা তাদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ছিল যে পপুলার ফ্রন্ট তার নেতা জর্জ হাবাশ’ও (১৯২৬-২০০৮) মুসলমান ছিলেন না, ছিলেন খ্রিস্টানই। জর্জ হাবাশের নেতৃত্বাধীন পপুলার ফ্রন্ট যুদ্ধটাকে সমরবাদে সীমিত রাখেনি, নিয়ে গিয়েছিল মনস্তাত্ত্বিক স্তরেও। তার পরিকল্পনায় বিমান হাইজ্যাকের অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর সব ঘটনা ঘটেছে; ইউরোপে ইসরায়েলি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ও দূতাবাসে হামলা হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা বুঝে নিয়েছে যে ফিলিস্তিনিদের ক্ষতটা অত্যন্ত গভীর, মনের জোরও কেমন প্রচ-। তাদের ধমকে বা প্রবোধে নিবৃত্ত করা যাবে না। জর্জ হাবাশ ‘অসলো চুক্তি’র দুই-রাষ্ট্র নীতি মানতেন না। তার সংগঠনের বক্তব্য ছিল রাষ্ট্র হবে একটাই, আর তার চরিত্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক; সে-রাষ্ট্রে ইহুদি, মুসলমান, খ্রিস্টানে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না, সবারই থাকবে সমানাধিকার। ১৯৬৯ সালে নিজেদের সংগঠনটিকে তারা একটি মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টিতে রূপান্তরিত করেন।

স্বভাবতই তারা সুবিধা করতে পারেননি। ইসরায়েলের আক্রমণ তো ছিলই, ছিল উৎখাতের জন্য সিআইএর অবিরাম তৎপরতা। জর্ডানের বাদশাহসহ আশপাশের সব মুসলিম শাসক ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিভাজন এবং পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনও পপুলার ফ্রন্টকে আঘাত করেছে। ওদিকে জর্জ হাবাশের নিজের স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়ছিল; শেষ দিকে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন ক্যানসারে। কিন্তু তার মনে কোনো অসুখ ছিল না। শিক্ষায় ও পেশায় এই চিকিৎসক লড়াইয়ের ময়দান থেকে কখনো সরে যাননি। তিনি জানতেন ইসরায়েলকে তোয়াজ করলে কুলাবে না, মধ্যস্থতাকারীদের ওপর ভরসা করাটা হবে আত্মঘাতী; লড়াইটা করতে হবে নিজেদেরই, আর সেটা হবে সর্বাত্মক। ‘দুই রাষ্ট্রের’ নীতি শেষ পর্যন্ত ‘এক রাষ্ট্রের’ নীতিতেই পরিণত হওয়ার অভিসন্ধিতে রয়েছে। আর সেটি হবে ইসরায়েলের ইহুদিবাদী রাষ্ট্র; সেখানে ফিলিস্তিনিদের থাকতে হবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবেই। পপুলার ফ্রন্টকে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে; ইয়াসির আরাফাতের আপসপন্থিরাও শেষ পর্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদের জায়গায় এসেছে হামাস ও ইসলামি জিহাদ; নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়কে যারা প্রধান করে তুলতে চায়। লড়ছে এখন তারাই। পশ্চিমারা হামাসকে বলে সন্ত্রাসবাদী, কিন্তু তারা এইটুকু জেনে নিশ্চিত আছে যে হামাস আর যাই করুক একেবারে গোড়া ধরে টান দেবে না, সমাজ বিপ্লব ঘটাবে না। মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চালানোর অভিপ্রায় বা ক্ষমতা কোনোটাই তাদের নেই। সমাজতন্ত্রী পপুলার ফ্রন্টকে সরিয়ে দেওয়ার ফলে সুবিধা হয়েছে সব পক্ষেরই; ইসরায়েলের, পশ্চিমা বিশ্বের, এবং ফিলিস্তিনের মৌলবাদীদেরও। পপুলার ফ্রন্টের নেতৃত্বে পরিচালিত হলে ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রাম ভিন্ন রূপ নিত। ইসরায়েল বড়াই করে যে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে তারাই একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে একটি কমিউনিস্ট পার্টি আছে। পপুলার ফ্রন্ট শক্তিশালী হলে কে জানে ইসরায়েলের কমিউনিস্টরাও হয়তো বিপ্লবী সংগ্রামে যুক্ত হতো।

ধর্মীয় মৌলবাদীরা বাংলাদেশেও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বর্তমান সরকার তাদের এত দিন নানাভাবে লাই দিয়ে এসেছে, এখন বুঝতে পারছে যে এরা একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠেছে, এবং আগামীতে সেভাবেই তৎপরতা চালাবে। সরকারের দৃষ্টিতে বিএনপিই মনে হয় একমাত্র শত্রু। আসলে কিন্তু বিএনপি হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী, শত্রু হচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদীরা। বিএনপি কিন্তু বেশ অসুবিধায় আছে, পঙ্গুদশাতেই বলা চলে, সরকার মনে হয় তাদের আরও জব্দ করতে চায়; কিন্তু বিএনপি সরে গেলে তার শূন্যতাটা ভরার জন্য যে হেফাজত আসার আশঙ্কা আছে সেটাকে সরকার মনে হয় বিবেচনায় নিচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গে তো ঠিক এ রকমটাই ঘটেছে। তৃণমূল এমনই ব্যবস্থা করেছে যার দরুন শূন্যস্থানে কংগ্রেস বা সিপিএম, কেউই নেই, জায়গাটা বিজেপি দখল করে নিয়েছে, কংগ্রেসের ও বামপন্থিদের ধ্বংসাবশের ওপর দাঁড়িয়ে।

হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্ব হয়তো তেমন একটা সুবিধা করতে পারবে না। তাদের বিরুদ্ধে-করা কয়েক বছরের পুরনো মামলাগুলো পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে, এবং তাদের আরও বড় দুর্বলতা নেতৃত্বের ভেতরেই রয়ে গেছে, সেটা হলো মুনাফালিপ্সা ও ভোগলালসা। কিন্তু হেফাজতের জন্য খুব বিস্তৃত একটা লালনভূমি তো সমাজে এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে, যেখানে রয়েছে লাখ লাখ মাদ্রাসা-শিক্ষিত মানুষ, যাদের জন্য জীবিকার পথ উন্মুক্ত নয়, অনেকেই বেকার কিংবা অর্ধ-বেকার, এবং স্বভাবতই বিক্ষুব্ধ; এদের সঙ্গে জামায়াতের লোকরা যদি যুক্ত হয় তবে সেটা মোটেই শুভ ঘটনা হবে না।

ধর্মীয় মৌলবাদীদের লালন ক্ষেত্রটি উর্বর থেকে উর্বরতর হচ্ছে। মাদ্রাসাশিক্ষিত অসন্তুষ্ট মানুষরা তো আছেই; সাধারণ মানুষের মধ্যেও দেখা দিয়েছে হতাশা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব। এ দেশের মানুষ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়েছে, তারা বড় রাষ্ট্র ভেঙে ছোট করেছে, কিন্তু তাদের মুক্তি আসেনি। জুলুমবাজি বড় হয়ে তাদের কাঁধে চেপে বসে আছে। ফলে এখন হতাশা দেখা দিয়েছে। মনোভাবটা হচ্ছে পরাজিতের। অন্যদিকে ব্যক্তি মানুষ দেখছে তার চারপাশে কেউ নেইসমাজ নেই, রাষ্ট্র নেই, আপনজনরাও নেই; নিজের ওপর তার আস্থা তাই কমে যাচ্ছে, সে ভাবছে ধর্ম ছাড়া তার জন্য অন্য কোনো আশ্রয় নেই, ভরসাও নেই। বাঁচান যদি তবে আল্লাহই বাঁচাবেন। আত্মবিশ্বাসহীনতা যত বাড়বে মৌলবাদের চর্চা ততই শক্তিশালী ও ব্যাপক হবে। দেশে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা ক্রমাগত কমছে; উল্টোদিকে ওয়াজ, মিলাদে বক্তৃতা, ফতোয়াএসব বেড়েই চলেছে। আবার এটাও তো না-মেনে উপায় নেই যে, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রকে যদি হিন্দু রাষ্ট্র করার চেষ্টা চলে, তবে তার প্রতিক্রিয়ায় ও অনুসরণে আমাদের রাষ্ট্রকে মুসলিম রাষ্ট্র করার অপচেষ্টা আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইবে।