দুঃখজনক হইলেও সত্য, সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বব্যাপী রাজনীতিতে উগ্রবাদের আওয়াজ দিনে দিনে তীব্র হইয়া উঠিতেছে। ইহার কারণ খুঁজিয়া দেখিবার প্রয়োজন রহিয়াছে। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক পেট হোয়েকেস্ট্রা সঠিকভাবেই বলিয়াছেন, যখনই পশ্চিমারা আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিয়াছে, তখনই সেইখানে উগ্রবাদ মাথা চারা দিয়া উঠিয়াছে। ইহা উন্নত, উন্নয়নশীল বা অনুন্নত সকল দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রেও একই রকম প্রযোজ্য। যেই সমাজে মানুষ কথা বলিতে পারে না, অধিকার হইতে বঞ্চিত হয়, সেই সমাজেই উগ্রবাদ বিকল্প হইয়া উঠে। যুক্তরাষ্ট্রেরই সাবেক ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন ইহাই উপলব্ধি করিয়া বলিয়াছেন, চরম ক্ষোভ, আতঙ্ক ও ভয় হইতেই উগ্রবাদের জন্ম হয়।
উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই উগ্রবাদ প্রকট হইবার আরো অধিক কারণ আমাদের নজরে আসিয়া থাকে। আমাদের এই দেখা উগ্রবাদকে সমর্থন নহে, বাস্তব দর্শন মাত্র। সমাজের বা রাষ্ট্রের দরিদ্রতা দুঃখবঞ্চনা যদি সকলে মিলিয়া ভোগ করিত তাহা হইলে কোনো খেদ বা আক্ষেপ থাকিত না; কিন্তু এই সমাজে দেখা যাইতেছে একদল মানুষ অন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাগ্যও কাড়িয়া লইতেছে। অফিস-আদালত—সর্বত্র এই শ্রেণির প্রভাব-দাপটের কারণে মানুষ অসহায় বোধ করিতেছে। আর সেই কারণেই উপায় না দেখিয়া তাহারা উগ্র হইয়া উঠিতেছে। একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি রাজনৈতিক প্রভাব খাটাইয়া প্রশাসনকে ক্রয় করিয়া লইবার প্রয়াস পায়। এই সকল উন্নয়নশীল বিশ্বের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনেরও একটি অংশ মুখাইয়া থাকে বিক্রয় হইবার জন্য; কিন্তু সাধারণ মানুষের এই উল্লম্ফন তাকাইয়া দেখা ছাড়া কিছু করিবার থাকে না। এই ঔদ্ধত্য দেখিতে দেখিতে তাহাদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হইতে থাকে। ফলে ইহার খেসারত দিতে হয় রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চর্চা করিয়া আসা ব্যক্তিদের। তাহারাও রাজনীতির উপর আস্থা হারাইয়া ফেলেন। এই অশুভ ধারা দীর্ঘদিন বিরাজিত থাকিলে একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে এমন শক্তির উত্থান হয়, যাহা কেবল পেশিকেই প্রাধান্য দেয়, জনমতকে নহে।
সুতরাং এই ধরনের চর্চা বন্ধ করা যে কোনো শুভবুদ্ধির দেশ পরিচালনাকারীদের অতিশয় জরুরি কর্তব্য। তাহাদের নিজেদের স্বার্থেই। সকল কিছু হাতের বাহিরে চলিয়া যাইবার পূর্বেই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যাহারা মানুষের মতামতকে নয়ছয় করিয়া দাবাইয়া রাখিতে চাহিতেছে, তাহারা কাহারা, কী তাহাদের পূর্বপরিচয়, কোথা হইতে আসিয়াছে, সমাজে তাহাদের অবদান কী—ইহাও রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করা বিশেষ কর্তব্য। দেশবিরোধী শক্তি যে কেবল রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় থাকে তাহা নহে, উহারা প্রশাসনেরও বিভিন্ন স্তরে ঘাপটি মারিয়া থাকে। সরকারের সুনাম বা বদনামে তাহাদের কস্মিনকালেও কিছু আসে যায় না। তাহারা নিজেদের সুবিধা পকেটস্থ করিবার ধান্ধায় ব্রত। ইহাদেরকে চিহ্নিত করিয়া যথাযথ ব্যবস্থা লওয়া বিশেষ প্রয়োজন। প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এমনকি বর্তমান যুগেও দেখিয়াছি, যখনই কোনো ক্ষমতার পালাবদল হয়, তখনই লুটপাটকারী গোষ্ঠী ভোল পালটাইয়া নতুন শক্তির সঙ্গে যোগদানের জন্য ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠে। ইহার কোনো ব্যত্যয় কোনো কালেই, কোনো দেশেই দেখা যায় নাই। ইহাদের সর্পের সহিত তুলনা করা যায়। বাটি ভরা দুধ খাইয়া মুহূর্তেই ফণা তুলিতে দ্বিধা করে না। তাই সঠিক সিদ্ধান্ত লইয়া ইহাদের দমন করা যে কোনো দায়িত্বপূর্ণ সরকারের জন্যই বিশেষ কর্তব্য।