বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি তাদের বার্ষিক দুর্নীতির ধারণাসূচক (সিপিআই)–২০২১ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ ১০০–এর মধ্যে ২৬ স্কোর পেয়েছে, যা ২০২০–এর সমান। এর আগে ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও বাংলাদেশের স্কোর ২৬ ছিল। স্কোর এবার মোটেও বাড়ল না শুধু তা-ই নয়, বরং সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে র্যাঙ্কিংয়ের বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ২০২০–এর তুলনায় এক ধাপ নিচে, ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৭তম, যা হতাশাব্যঞ্জক। যদিও সর্বনিম্ন স্কোর প্রাপ্তের অবস্থান থেকে গণনা করলে বাংলাদেশের অবস্থান গতবারের তুলনায় এক ধাপ ওপরে, ১৩তম। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অবস্থান বরাবরের মতো এবারও দ্বিতীয় সর্বনিম্ন, কেবল আফগানিস্তানের ওপর এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন। অন্যদিকে আমাদের স্কোর বৈশ্বিক গড় ৪৩–এর অনেক পেছনেই রয়ে গেছে। উল্লেখ্য, ২০১২-২০২১—এই ১০ বছরে স্কোরের বিশ্লেষণে বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি, ২৬–এ স্থবির হয়ে রয়েছে, যা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে এই দশকে আমাদের ব্যর্থতার পরিচায়ক।
কোনো দেশই শতভাগ স্কোর পায়নি, অর্থাৎ বিশ্বের কোনো দেশই দুর্নীতিমুক্ত নয়। ১৩০টি দেশ (৭২%) ৫০–এর কম স্কোর পেয়েছে। ২০২০ সালে এই হার ছিল ৬৭, অর্থাৎ সার্বিক বিবেচনায় বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ১০০টি (৫৫%) দেশের স্কোর বৈশ্বিক গড় ৪৩–এর নিচে; যা গতবারও একই পর্যায়ে ছিল। ১০ বছরের স্কোরের গতির বিশ্লেষণে মিশ্র চিত্র দেখা যায়—৮৪টি দেশের স্কোর বেড়েছে, ৮৩টি দেশের কমেছে, ৭টি দেশ বাংলাদেশের মতো একই পর্যায়ে রয়েছে। ৭টি দেশের ক্ষেত্রে টাইম সিরিজ বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি।
৮৮ স্কোর পেয়ে তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে যৌথভাবে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। অন্য যেসব দেশ ৭৫–এর বেশি স্কোর পেয়ে ভালো ফল করেছে, তারা হচ্ছে নরওয়ে, সিঙ্গাপুর ও সুইডেন (৮৫), সুইজারল্যান্ড (৮৪), নেদারল্যান্ডস (৮২), লুক্সেমবার্গ (৮১), জার্মানি (৮০), যুক্তরাজ্য (৭৮) ও হংকং (৭৬)। তথাকথিত উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যারা দুর্বল ফল পেয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র (৬৭), স্পেন (৬১), ইতালি (৫৬), চীন (৪৫), তুরস্ক (৩৮) ও রাশিয়া (২৯)। মাত্র ১১ স্কোর পেয়ে সর্বনিম্ন অবস্থানে দক্ষিণ সুদান। অন্যান্য যারা তালিকার সর্বনিম্নে, তারা হলো সিরিয়া, সোমালিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইয়েমেন, উত্তর কোরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইক্যুইটোরিয়াল গিনি, তুর্কমেনিস্তান, ডি আর কঙ্গো ও বুরুন্ডি; যাদের অনেকেই হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত অথবা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বরাবরের মতো ভুটান ৬৮ স্কোর এবং ওপর থেকে ২৫তম অবস্থান নিয়ে সবচেয়ে ভালো ফল পেয়েছে। এরপর ভারত ও মালদ্বীপ যদিও ভুটানের তুলনায় অনেক পেছনে রয়েছে—উভয় দেশ ৪০ পয়েন্ট পেয়ে ৮৫তম। অন্যদিকে মালদ্বীপ ও পাকিস্তানের স্কোর ৩ পয়েন্ট করে কমেছে—মালদ্বীপ ২০২০–এ ৪৩ স্কোর পেয়েছিল, আর পাকিস্তানের স্কোর ৩১ থেকে ২৮–এ নেমেছে। নেপালের স্কোর ২০২০–এর মতো এবারও ৩৩ রয়েছে। শ্রীলঙ্কা ৩৮ থেকে নেমে ৩৭ পেয়েছে আর আফগানিস্তানের স্কোর ১৯ থেকে নেমে ১৬ হয়েছে।
২০০১-২০০৫ মেয়াদে সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকার গ্লানি কাটিয়ে বাংলাদেশ সাম্প্রতিককালে কিছুটা উন্নতি করলেও আমাদের স্কোর এখনো বিব্রতকরভাবে ২০–এর কোঠায়। তদুপরি ২০২০–এর তুলনায় সূচকের উচ্চক্রম অনুযায়ী ১৪৬ থেকে ১৪৭ নেমে আসা হতাশাব্যঞ্জক। হতাশাব্যঞ্জক বিশেষত এ কারণে, যে মেয়াদের (নভেম্বর ২০১৮-সেপ্টেম্বর ২০২১) তথ্যের ওপর নির্ভর করে এবারের সূচকটি প্রণীত, সেটি বাংলাদেশের জন্য হওয়ার কথা ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার মেয়াদ। ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রকাশ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণা করেছিলেন। মন্ত্রিসভা গঠনের পর তিনি মন্ত্রীদের দুর্নীতি সম্পর্কে সাবধান করেছিলেন। পরবর্তী সময় জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে দুর্নীতিবিরোধী সুনির্দিষ্ট চারটি বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন—যারা দুর্নীতিতে জড়িত, তাদের আত্মশুদ্ধি চর্চা করতে হবে; আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে; তথ্যপ্রযুক্তি সম্প্রসারণ করতে হবে এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে জনগণের অংশগ্রহণ ও গণমাধ্যমের সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। পরে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শুদ্ধি অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের দলের নেতা–কর্মীসহ কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না মর্মে ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময় করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কোনো প্রকার দুর্নীতি সহ্য করা হবে না—এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন।
গণতান্ত্রিক জবাবদিহির মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের কারণে ক্রমবর্ধমানভাবে অকার্যকরতার পথে চলছে। যার কারণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার অঙ্গীকারের বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের ওপর অর্পিত, তাদের মধ্যেই বিচরণ করে দুর্নীতির অনুঘটক, অংশগ্রহণকারী, সুবিধাভোগী ও সুরক্ষাকারী।
বাস্তবে যা ঘটেছে, তা সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশেষ করে, একশ্রেণির অসাধু মানুষ, যারা অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমতার কাছাকাছি বিচরণ করেন, করোনাজনিত জাতীয় দুর্যোগকে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদ বিকাশের উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছেন। স্থানীয় পর্যায়ে করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে অসাধু কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা লিপ্ত হয়েছেন বিব্রতকর অনিয়ম-দুর্নীতিতে। এমনকি হতদরিদ্রদের জন্য বিশেষ সহায়তা হিসেবে সরকারপ্রদত্ত আর্থিক অনুদান কার্যক্রমও বাদ পড়েনি তাদের দুর্নীতির থাবা থেকে। অন্যদিকে ক্রয় ও সরবরাহ খাতে দেখা গেল দুর্নীতির মহোৎসব, যাতে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী-ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে লিপ্ত থাকলেন বরাবরের মতোই সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের একাংশের পাশাপাশি ক্ষমতাবান রাজনৈতিক মহলের একাংশ, যারা এসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের কেলেঙ্কারি অব্যাহত রাখলেন। অর্থ পাচারসহ আর্থিক খাতে বিভিন্ন প্রকার জালিয়াতির ঘটনা ঘন ঘন হেডলাইন হয়েছে, যেখানে বিত্তশালী ও ক্ষমতাধর ব্যবসায়ী মহলের একাংশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের একাংশ ও রাজনৈতিক নেতা, যাদের কারও কারও বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের পাশাপাশি মানব পাচারের অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে। একজনকে অভূতপূর্বভাবে দেশের বাইরে সাজা ভোগ করতে হচ্ছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা বাস্তবায়নে ব্যর্থতার পেছনে অন্যতম অবদান রয়েছে রাজনীতির সঙ্গে অর্থ, দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতির ক্রমবর্ধমান ওতপ্রোত সম্পর্ক, যা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করছে। গণতান্ত্রিক জবাবদিহির মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের কারণে ক্রমবর্ধমানভাবে অকার্যকরতার পথে চলছে। যার কারণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার অঙ্গীকারের বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের ওপর অর্পিত, তাদের মধ্যেই বিচরণ করে দুর্নীতির অনুঘটক, অংশগ্রহণকারী, সুবিধাভোগী ও সুরক্ষাকারী। প্রাতিষ্ঠানিক অকার্যকরতার প্রকট দৃষ্টান্ত দুর্নীতি, জালিয়াতি ও লুটপাটের কারণে জর্জরিত ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত। এ খাতে নীতি-সিদ্ধান্ত কী হবে, তা অনেক সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে না, করেন ঋণখেলাপি আর জালিয়াতিতে নিমজ্জিত ব্যক্তিদেরই একাংশ। যাঁরা দুর্নীতি করেন, বিশেষ করে তথাকথিত রুই-কাতলার জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়—এমন দৃষ্টান্ত বিরল। বাস্তবতা হচ্ছে, তাঁরা কার্যত বিচারহীনতা উপভোগ করেন মূলত রাজনৈতিক, আর্থিক বা প্রশাসনিক সম্পৃক্ততার কারণে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শুদ্ধাচার–সহায়ক আমূল পরিবর্তন ব্যতিরেকে দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অর্থ ও দুর্বৃত্তায়ন থেকে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও অবস্থানকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। আইনের শাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে তার স্ব–আরোপিত সীমারেখা থেকে বের হতে হবে, যে সীমারেখার কারণে তার পক্ষে প্রভাবশালী মহলের দুর্নীতির ক্ষেত্রে কার্যকর জবাবদিহিমূলক পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। আইনের চোখে সবাই সমান—এই ভিত্তি থেকে ব্যক্তির পরিচয় বা অবস্থান দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে কমিশন কাজ করবে, এটিই তার আইনগত বাধ্যবাধকতা এবং জনগণের প্রত্যাশা।
২০২১–এর সিপিআই বিশ্লেষণ করে টিআই বলছে, দুর্নীতি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষা এবং বিকাশে অন্যতম প্রতিবন্ধক। দুর্নীতির কারণে মানবাধিকার ও মানবাধিকারকর্মীর জন্য নিরাপত্তাহীন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। টিআইয়ের সূত্র অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী যে ৩৩১ জন কর্মীর হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার ৯৮ শতাংশ ঘটেছে এমন সব দেশে, যেখানে দুর্নীতির ব্যাপকতা প্রকট। তদুপরি কমপক্ষে ২০টি এরূপ হত্যার শিকার হয়েছেন দুর্নীতিবিরোধী কর্মী। দুর্নীতির দুষ্টচক্র গণতান্ত্রিক অবক্ষয়ের অনুঘটক; এর মাধ্যমে বিশেষ করে গণতন্ত্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দখল করার মাধ্যমে অকার্যকর করে দেওয়া হয়; যার কারণে মানবাধিকার হরণ বৃদ্ধি পায়, মানুষের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার খর্ব হয় এবং একই সঙ্গে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়। যার কারণে দুর্নীতির গভীরতর ও ব্যাপকতর বিস্তৃতি ঘটে।
বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা ও নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, দুর্নীতিকে সুরক্ষা প্রদান ও বিকাশে বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা খর্ব করাকে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যার মাধ্যমে দুর্নীতিকে সামাজিকভাবে প্রতিহত করার পরিবেশকে সংকুচিত করা হয়। দুর্নীতির অবাধ প্রসারের কারণে দুর্নীতিবাজদের জবাবদিহি নিশ্চিতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে পড়ে; এর ফলে বিচারহীনতার বিকাশ ঘটে এবং দুর্নীতিকে জীবনাচরণের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। একদিকে আইনের শাসনের ঘাটতি, অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালো আইনের বিতর্কিত ধারা এবং তার অপব্যবহার বাংলাদেশে যেভাবে বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে, তাতে যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, আমরা আজ কোন পথে?