পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি দুর্নীতি রয়েছে। লোভ ও অতিরিক্ত ভোগের আকাঙ্ক্ষা থেকেই দুর্নীতির উত্পত্তি হয়। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ব্যক্তিগত লাভের জন্য সরকারি দায়িত্ব পালনের বিধিবিধান ও কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে কাউকে কোনো সুবিধা দেয়া হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি শুধু সরকারি অফিসে সীমাবদ্ধ নেই। সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। কেবল অভাবের তাড়নায় মানুষ দুর্নীতি করে—এটি সত্য নয়। বিত্তশালী কর্মকর্তা বা ব্যক্তি আরো অর্থ সম্পদের জন্য দুর্নীতি করে। মানুষের মধ্যে নীতি-নৈতিকতার ঘাটতি হলেই দুর্নীতি জেঁকে বসে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্নীতির কম-বেশি বিস্তৃতি লক্ষ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি কনভেনশন বা রেজল্যুশন পাস হয়। ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর গৃহীত এ রেজল্যুশন (নং-৫৮/৪) ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে কার্যকর হয়। এ সনদ কার্যকর হওয়ার তারিখ অর্থাৎ ৯ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দমন দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে শুদ্ধতা, নৈতিকতা, সত্যবাদিতা এবং স্বাভাবিক সততা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য।
জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী এ কনভেনশন বা সনদে বলা হয়েছে যে, দুর্নীতি সমাজের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে, গণতান্ত্রিক কাঠামো, নৈতিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারকে ক্ষুণ্ন করে এবং টেকসই উন্নয়ন ও আইনের শাসনকে বিপন্ন করে। সুতরাং এ কনভেনশনকে দক্ষতার সঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রযুক্তিগত সহায়তা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সারা বিশ্বের সরকার, বেসরকারি সংস্থা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গণমাধ্যম ও সাধারণ নাগরিকরা প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দিবস’ হিসেবে পালন করে।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতি বছর দিবসটি পালনার্থে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ কর্মসূচিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাঁকজমকপূর্ণ র্যালি ও আলোচনা সভা। এবারের ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস-২০২১’-এর আলোচনা সভায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির একটি ভাষণ সম্প্রচার করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার ভাষণে বলেন, দেশ ও সমাজ থেকে যেকোনো মূল্যে দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের মূলোৎপাটন করতে হবে। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে এবং দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। তিনি দুদকের সব পর্যায়ের কর্মচারীদের সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা ও নৈতিকতা প্রদর্শন করার আহ্বান জানান এবং দুর্নীতি দমন কার্যক্রমে নিয়োজিত কিছুসংখ্যক লোকের জন্য যাতে পুরো দুর্নীতি দমন কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয় সেদিকেও লক্ষ রাখার নির্দেশ দেন।
রাষ্ট্রপতির ভাষণের বিষয়বস্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়। দুর্নীতি দমন কমিশনের নিজ অফিসের কতিপয় কর্মকর্তার নৈতিকতার ঘাটতির বিষয়টি কারো অজানা নয়। যে প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি উদ্ঘাটন ও দুর্নীতিবাজদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য দায়িত্ববান সে প্রতিষ্ঠানেই যদি দুর্নীতি ও অনিয়ম থাকে তবে দুর্নীতি প্রতিরোধের চেষ্টাটি ব্যহত হওয়া স্বাভাবিক। কোনো কোনো অসৎ কর্মকর্তা কর্তৃক উেকাচের বিনিময়ে বড় বড় দুর্নীতির মামলাও যেমন সহজ করে দেয়ার সম্ভাবনা থাকে, আবার অভিযুক্ত ব্যক্তির কথিত দুর্নীতি প্রমাণ হওয়ার আগেই তাকে হয়রানি করে তার জীবন দুর্বিষহ ও অপূরণীয় ক্ষতি করতেও দেখা যায়। দুদকের সাবেক এক চেয়ারম্যান তার কোনো একটি বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন যে, কোনো সরকারি কর্মচারী দুদকের মামলায় অভিযুক্ত হলে ফলাফলের জন্য অন্তত সাত-আট বছর অপেক্ষা করতে হয়। কখনো কখনো এক যুগের বেশি সময় লেগে যায়। এ সময়ের মধ্যে ওই কর্মচারীর কোনো পদোন্নতি হয় না, কিংবা ভালো পোস্টিং পান না। জেল-জুলুম এবং মামলা-মোকদ্দমায় ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। বিচার প্রক্রিয়ায় তিনি যদি খালাসও পান, তার হারিয়ে যাওয়া চাকরি জীবনের ক্ষতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আর পূরণ হয় না। দেশের যেসব প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থা তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট, সেসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিতদের সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে এসব প্রতিষ্ঠানের সাফল্য ও ব্যর্থতা। আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন। দুদক আইনে এ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে কয়েকটি মামলায় অনুসন্ধানের পর মামলা করেই আসামিদের গ্রেফতার করা হয়, যদিও এরূপ গ্রেফতার করার বিধান দুদক আইনে নেই। পরবর্তী সময়ে এ গ্রেফতারের বিষয়টি নিয়মে পরিণত হয়েছে। অধিকতর তদন্তে অনেক মামলায় দুদক এফআরটি দাখিল করে, অর্থাৎ আসামিরা দোষী সাব্যস্ত হন না। তাহলে ভুক্তভোগী আসামি যে জেল খাটলেন তা কোন অপরাধে?
পর্যালোচনা করে করে দেখা গেছে, দুদকে অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মকর্তাদের যে সময় বেঁধে দেয়া হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত সময়ে তারা কাজ শেষ করেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৮-১০ বারও সময় বৃদ্ধি করা হয়। তথ্যপ্রমাণাদি সংগ্রহ করতে কিছুটা সময় লাগতেই পারে। তাই বলে বছরের পর বছর তদন্ত ঝুলিয়ে রাখা অনুচিত। অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তি করে অভিযুক্তকে খালাস কিংবা শাস্তি প্রদান করা হলে আইনের শাসন নিশ্চিত হয়।
বাংলাদেশে প্রচলিত দুর্নীতির ব্যাপকতা পর্যালোচনা করলে সত্যিই হতাশ হতে হয়। দেশের রাজনীতিবিদ, আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি থেকে শুরু করে প্রতিটি পেশায় জড়িত ব্যক্তিরা এবং সাধারণ জনতার মধ্যেও কম-বেশি দুর্নীতি রয়েছে। যত দিন যাচ্ছে, দুর্নীতির ব্যাপকতা ততই বাড়ছে।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী সংগ্রামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অধিকারী। এরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য রক্ত দিয়েছে। আবার ধর্মপ্রাণ, পরোপকারী, অতিথিপরায়ণ ও সহজ-সরল মানুষ হিসেবে দেশ-বিদেশে সুনামও রয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে মিথ্যাচার, প্রতারণা, পরনিন্দা, স্বার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতা ও অসততার দুর্নাম। লোকমুখে যেসব অভিযোগ সচরাচর শোনা যায় সেগুলো হলো—সরকারি অফিসে তদবির অথবা উেকাচ না দিলে কাজ হয় না। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা অতিমুনাফাখোর, বিশেষ বিশেষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় কোনো কার্যোপলক্ষে টাকা না দিলে ন্যায্য কাজ তো হবেই না, বরং অহেতুক হয়রানির সম্মুখীন হতে হয় ইত্যাদি।
দেশে দুর্নীতির ব্যাপ্তি দেখে স্বাভাবিকভাবেই ধারণা হতে পারে, আমাদের গোড়ায় গলদ রয়েছে। আমরা বিদেশী ঔপনিবেশিক শাসন, স্বৈরাচার, একনায়ক কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শাসিত হয়েছি। নীতি-নৈতিকতার শিক্ষায় আমাদের রয়েছে বিরাট ঘাটতি। কি পরিবার, কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কি সমাজ কোথাও সততা ও নীতি-নৈতিকতাকে এক নম্বর অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয় না। ব্যক্তিস্বার্থকে আমরা জনস্বার্থ বা সমষ্টিগত স্বার্থের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিই। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ন্যায়-অন্যায় বিচার করি না। যেসব সংস্থা দুর্নীতি বিষয়ে গবেষণা ও রিপোর্ট করে তাদের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারি যেসব অফিসে সরাসরি জনসাধারণের কার্যোপলক্ষে যাতায়াত রয়েছে সেসব অফিসে দুর্নীতি বেশি হয়। যেমন ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস, পানি বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল পরিশোধের অফিস, হিসাবরক্ষণ অফিস, আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টম-শুল্ক পরিশোধের অফিস, থানা পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, রাজউক, মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স অফিস ইত্যাদি। যেখানে দুর্নীতি হয় সেখানে সেবাদাতা ও গ্রহীতা উভয়েই দুর্নীতির দোষে দুষ্ট।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পল্লী উন্নয়ন, পিডব্লিউডি, হিসাব ও নিরীক্ষা প্রভৃতি অফিসের প্রকল্পের কাজসহ নানা বিল পরিশোধেও বড় রকমের ঘুষ দুর্নীতির কথা শোনা যায়। এভাবে তালিকাভুক্ত না করেও বলা যায়, যেখানে অর্থ খরচ কিংবা কোনো অনুমোদন প্রক্রিয়া রয়েছে, সেখানেই কমবেশি ঘুষ-দুর্নীতির সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ওজনে কম দেয়া, অতিমুনাফাখোরি, খাদ্য ও ব্যবহূত দ্রব্যাদিতে ভেজাল দেয়া, কর ও ভ্যাট ফাঁকি তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সঠিকভাবে পাঠদান না করানো, হাসপাতালে অতিরিক্ত ফি আদায় বা অপ্রয়োজনীয় ও ভুল চিকিৎসা, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যাংকঋণ গ্রহণ, মানি লন্ডারিং করে বিদেশে অর্থ প্রেরণ প্রভৃতি অন্যায়-অপরাধের কথা হরহামেশাই শোনা যায়। ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাউকে লাভবান এবং কারো ক্ষতি করা, কোর্ট বা যেকোনো তদন্তে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন প্রভৃতি আরো উচ্চমানের দুর্নীতি।
আমাদের দেশের দুর্নীতির ধরন অনেকটা ছোঁয়াচে রোগের মতো। একজনের মধ্য থেকে অন্যজনের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে। বিশেষ করে সামর্থ্যবান, ধনী, শিক্ষিত, ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনুসরণে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাবান, কম শিক্ষিত লোকরাও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে ওঠে। আবার কোথাও দুর্নীতি হয় সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। কোনো ব্যক্তি বা চাকরিজীবী স্বাভাবিক অবস্থায় দুর্নীতি না করলেও সুযোগ পেলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক ও পরিবেশের কারণেও মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। প্রভাবশালীরা দুর্নীতি করে যদি পার পেয়ে যায় তবে অন্যরাও দুর্নীতি করবে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশের দুর্নীতির প্রকোপ আগে থেকেই তুলনামূলকভাবে বেশি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সাল থেকেই দুর্নীতি বিস্তার লাভ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দেয়া বিভিন্ন বক্তৃতায় দেশের দুর্নীতি, অতিমুনাফাখোরি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, কালোবাজারি প্রভৃতির বিরুদ্ধে কষ্ট ও হতাশা ফুটে ওঠে। দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার জন্যই ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে তিনি সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে বাকশাল গঠন করেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুঃখজনক মৃত্যুর পর সামরিক সরকার ও পরবর্তী সময়ে ‘স্বৈরাচারী’ সরকার দেশ শাসনের ফলে দুর্নীতি আরো ডালপালা বিস্তার করে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশের প্রভূত অগ্রগতি হলেও দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেন। তবে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নিয়োজিত রাজনীতিকরা, সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ, সাধারণ মানুষ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রভৃতি সবার সদিচ্ছা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা না থাকলে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। দুর্নীতিসংক্রান্ত বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থাগুলোর রিপোর্ট অনুযায়ী বহু পূর্ব থেকেই দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ পর্যায়ে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে ২০০১-০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্বের প্রথম স্থানে ছিল। পরবর্তী সময়ে প্রথম স্থানে না থাকলেও বাংলাদেশের অবস্থান সন্তোষজনক অবস্থায় পৌঁছায়নি। ‘ট্রেইস ইন্টারন্যাশনাল’ নামক একটি গবেষণা সংস্থার এ বছরের (২০২১) ‘গ্লোবাল ব্রাইবারি রিস্ক ইনডেক্স কান্ট্রি র্যাংকিং’-এ ১৯৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৭ নম্বরে দেখানো হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে ঘুষের ঝুঁকির বিস্তারে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন (অর্থাৎ ঘুষ-দুর্নীতির বিচারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঝুঁকির দেশ)। আফগানিস্তানের অবস্থান সর্বনিম্ন ১৭৪-এ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২০ সালের ‘করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স’ অনুযায়ীও দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্নীতিতে আফগানিস্তান শীর্ষে এবং বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে। দুটি গবেষণাতেই দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ।
অনেকেই বলে থাকেন, আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন তেমন কার্যকর নয়। কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। তবে সত্য কথা হলো, দুদকের পক্ষে সারা দেশের সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। তাছাড়া সারা দেশের দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণও দুদকের কাছে নেই। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতির অনুসন্ধানের জন্য ১৯৫৩ সালে ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ সৃষ্টি হলেও পরবর্তী সময়ে কমিশনের জন্য প্রণীত আইনে দুদকের অধিক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় জনবল ও অফিস বিস্তৃতি হয়নি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকলেই কেবল দুদক কাজ করতে পারে।
দুর্নীতির কারণে মানুষের নীতি-নৈতিকতা নষ্ট হয়। শুধু তা-ই নয়, দুর্নীতি দেশের সামাজিক পরিবেশ, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি নষ্ট করে। দেশে বৈষম্য বাড়ে। সব ক্ষেত্রে ক্ষমতাশালীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে আমজনতা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্নীতিবাজরা নির্দ্বিধায় দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে অর্থ পাচার করছে। এক হিসাব অনুযায়ী জানা যায়, প্রতি বছরে বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে বা অন্যান্য উপায়ে ব্যাংকের টাকা লুট করে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পরিচালক কিংবা ব্যাংকের ক্লায়েন্ট বিদেশে চলে যাচ্ছেন। অর্থ-সম্পদ না থাকলে আজকাল ভোটের রাজনীতিতেও আসা যায় না। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য, হানাহানি, সন্ত্রাস, কেন্দ্রদখল প্রভৃতি যা দেশের জনগণ দেখেছে তার পেছনে অসৎ পথে উপার্জিত অর্থ সম্পদের প্রাচুর্য বা ভবিষ্যতে সম্পদ লুণ্ঠনের আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে। দেশের ভবিষ্যতের জন্য এসবই অশুভ লক্ষণ।
বাংলাদেশের অব্যাহত অগ্রগতি সারা বিশ্বের বিস্ময়। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি হয়েছে তার পেছনে রয়েছে সরকারের নানা নীতিসহায়তা, উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের শিল্প স্থাপন, কর্মসংস্থান, সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান। উন্নয়নের এ পর্যায়ে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রচ্ছন্ন দুর্নীতির কারণে খরচ বেড়ে যাচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজের মান খারাপ হচ্ছে। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের বিষয় যেমন বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে, তেমনি দুর্নীতির বিষয়টিও কারো অজানা নয়। দেশে দুর্নীতির প্রকোপ এতটা বেশি যে বর্তমানে মানুষের চিন্তা-চেতনায়ও এটি সংক্রমিত হচ্ছে, অথচ এ দেশে এরূপ বেপরোয়া দুর্নীতি মোটেও কাম্য নয়। আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। ঘুষ, দুর্নীতি, মানুষকে ঠকানো, অর্থ আত্মসাৎ, মারামারি-খুনাখুনি প্রভৃতি ধর্মের দৃষ্টিতে এতটা জঘন্য কাজ যে এসব অপরাধ আল্লাহ কিছুতেই ক্ষমা করবেন না। যাদের মধ্যে প্রকৃত ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা রয়েছে তারা এসব অপরাধে জড়িত হন না। সেজন্য আমাদের পারিবারিক পরিবেশ, শিক্ষা ব্যবস্থা, সরকারি কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধর্মশিক্ষা ও নীতি-নৈতিকতার শিক্ষার স্থান করে দিতে হবে। জাতি গঠনে এ শিক্ষা খুব কার্যকরী।
সরকারি চাকুরেদের উচ্চপদে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি প্রভৃতিতে অন্য কোনো বিষয়ে প্রাধান্য বাদ দিয়ে সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠার মূল্যায়ন করতে হবে। সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। তাদের জনগণ ও স্টেকহোল্ডারদের অভাব-অভিযোগ শুনে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে তত্পর হতে হবে। চাকরির প্রথম দিকের প্রশিক্ষণগুলোতে সততা, নৈতিকতা, দেশপ্রেমের ওপর প্রাধান্য দিয়ে সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে। দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রেও সন্ত্রাসী, লোভী ও অসৎ ব্যক্তিদের বয়কট করতে হবে। দেশে লাগামহীন দুর্নীতি যেমন হয়, তার বিপরীতে সৎ, দেশপ্রেমিক ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিরাও রয়েছেন। সমাজের ও দেশের জন্য তারা উদাহরণস্বরূপ ও অনুসরণযোগ্য। দেশ এগিয়ে যাওয়ার পেছনে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য।
সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী ও দেশপ্রেমিক সুশীল ব্যক্তিরা নানা জায়গায় তাদের আলোচনা ও লেখালেখিতে দুর্নীতি প্রতিরোধের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যানের সাম্প্রতিক একটি প্রবন্ধের উপসংহার এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘গত ৫০ বছরে আমাদের সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো, আমরা দুর্নীতি রোধ করতে পারিনি। দুর্নীতির পরিসর বেড়েছে। আগামীতে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো কার্যকর করে তুলতে যোগ্যদের যথাস্থানে পদায়নের বিকল্প নেই। যেকোনো মূল্যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন প্রতিহত করতে হবে। এর সঙ্গে সমাজের সর্বস্তরে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। বিজয়ের মাসে সে প্রত্যাশাই রাখছি।’
দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সৎ ও যোগ্যদের যথাস্থানে বসিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নিতে হবে। জনগণকেও এ ব্যাপারে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধই হোক বাংলাদেশের এক নম্বর অগ্রাধিকার।