Nurul Amin

ধর্মান্ধতার কারণে উগ্রবাদের বিস্তার হয়

সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের অপব্যবহার ও ধর্মান্ধতার মাত্রা, গভীরতা ও বিস্তার দেখে মনে হচ্ছে যে ধর্মের আবির্ভাব হয়েছিল পৃথিবীর মানুষকে বিশৃঙ্খলা, অশান্তি ও গোঁড়ামি থেকে মুক্তি দিতে সেই হয়ে উঠেছে গোঁড়ামিপূর্ণ।
ধর্মীয় উগ্রবাদ এখন জাতিরাষ্ট্রের গন্ডি পেরিয়ে গোটা বিশ্বের শান্তি, সংহতি, প্রগতি, অগ্রগতির সামনে বিষাক্ত ফণা তুলে ধরেছে। ধর্মীয় উগ্রবাদের বিষবাষ্প আজ পুরো মানবজাতিকে ঠেলে দিচ্ছে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার দিকে। আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বে ধর্মকে রাজনীতিকরণ চলছে ব্যাপকভাবে। তার ফায়দা লুটাচ্ছে কিছু নামধারী লেবাসী সেক্যুলার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
দার্শনিক সেনেকা বলছিলেন- Religion is regarded by the Common people as true, by the wise as false, and by the rulers as useful. দার্শনিকের এই উক্তির মর্মকথা আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ মানুষ ও তরুণ সমাজের ওপর কীভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প অনুপ্রবেশ করাচ্ছে তা খেয়াল করলেই বুঝতে পারি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রে বিষয়টা জিনগত কিনা জানা নেই। ধর্মভিত্তিক ও কথিত আধুনিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা সবাই পীর বা ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ হয়ে উঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু আদতে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য রাজনৈতিক সুবিধা হাসিল করা। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতারা মূলত প্রান্তিক স্তরের মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন। কিন্তু তাদের প্রধান মোটিভ বা উদ্দেশ্যই এইসব ধর্মভীরু মানুষকে দলে ভেড়ানো। অন্যদিকে প্রায়শই দেখা যায় একটু শিক্ষিত ও নিজেকে প্রগতিশীল দাবি করা সমাজের কিছু অংশ সাধারণ মানুষের সঙ্গে অন্তত দাম্ভিক আচরণ করে। ফলশ্রুতিতে এইসব প্রান্তিক স্তরের মানুষ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ফাঁদে পড়ছে প্রতিনিয়ত।
এছাড়াও বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও গবেষণা থেকে প্রতীয়মান যে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে তরুণ সমাজকে। তরুণ সমাজের ধর্মীয় উগ্রবাদে বশবর্তী হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার সুনির্দিষ্ট কারণ নির্ধারণ করা কঠিন হলেও এর জন্য মূলত পরিবারকেন্দ্রিক সামাজিকরণকে বহুলাংশে দায়ী করা যায়। কারণ সমাজবিজ্ঞানীগণ শিশু, কিশোর ও তরুণের সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা নিয়ে গড়ে ওঠার জন্য পরিবারকে একটি মডেল প্লেস হিসাবে চিত্রিত করেন। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ ছাড়াও পাশ্চাত্যের মতো উন্নত দেশগুলোতে সামাজিকরণের ভিন্নতার জন্য তরুণ সমাজের মাঝে জঙ্গিবাদের ভয়ানক দর্শন প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।
ফলস্বরূপ তা সামাজিক স্থিতিশীলকে বহুলাংশে বাধাগ্রস্ত করছে। আমাদের মনে রাখা দরকার বৈচিত্র্য বা ডাইভার্সিটিই একটি আদর্শিক সমাজ কাঠামোর অন্যতম উপাদান। একটি স্থিতিশীল সমাজের পূর্বশর্ত হলো সেই সমাজে যেমন ভিন্ন ভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোষ্ঠীর মানুষ সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করবে। ঠিক তেমনি সেই সমাজে তারা সমান মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও পাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা জরুরি যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেন তার সীমা পেরিয়ে না যায়। দার্শনিক বার্নার্ড শ তার লাঠি ঘুরিয়ে চলা এক বন্ধুকে বলেছিলেন, তোমার লাঠির ঘুরিয়ে চলার স্বাধীনতা আমার নাকের ডগা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। একইভাবে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও ভিন্নমতের অধিকার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেন কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের সামিল না হয়, যা সমাজের সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানকে প্রকম্পিত করে। নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ, ধর্মমতকে চিরন্তন ও একমাত্র শাশ্বত ভাবার মধ্যেই রয়েছে ধর্মীয় উগ্রবাদের বীজ। ধর্মীয় উগ্রবাদের বশবর্তী হয়ে মানুষ ভুলে যায় ধর্মের মূল অর্থ ও উদ্দেশ্য। ধর্ম মানেই মনুষ্যত্ব- যেমন আগুনের ধর্মই অগ্নিত্ব, পশুর ধর্মই পশুত্ব। তেমনি মানুষের ধর্ম মানুষের পরিপূর্ণতা। এই পরিপূর্ণতাকে কোন এক অংশে বিশেষভাবে খন্ডিত করে তাকে ধর্মীয় লেবাস বা পোশাক পরিয়ে মনুষ্যত্বকে আঘাত করে। পরিণতিতে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে সমাজের স্বাভাবিক গতিশীলতা। সমাজে বারবার হেরে যাচ্ছে প্রগতিশীল অংশ এবং জয়ী হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী।