Nurul Amin

মৌলবাদ, ধর্মীয় সন্ত্রাস এবং সাম্রজবাদ… আমাদের করনীয় কি?

পুঁজিবাদ সম্প্রসারণে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা খুবই সহায়ক হয়েছিলো। আর উপনিবেশগুলোতে রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্প্রসারণে মিশনারীদের বিভিন্ন মাত্রার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো, ভূমিকা ছিলো স্থানীয় ধর্মীয় নেতা ও ক্ষমতাবানদেরও। আবার ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী ভূমিকাতেও মিশনারী ও স্থানীয় কোনো কোনো ধর্মীয় নেতার ভূমিকাও দেখা গেছে। উত্তর উপনিবেশকালে প্রান্তস্থ দেশগুলোতে খুঁটি ধরে রাখতে, সমাজতন্ত্র ঠেকাতে পুঁজিবাদী কেন্দ্র বা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ধর্মীয় শক্তি ব্যবহারে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। মূলধারার চার্চ সাম্রাজ্যবাদের খুঁটি হিসেবেই বরাবর ভূমিকা পালন করেছে। একদিকে মুসলিম রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখা অন্যদিকে ইহুদীবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের দীর্ঘমেয়াদী অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে। মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে ইসলামপন্থী দল ও ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র বিরোধী আতঙ্ক সৃষ্টি করবার কাজ সহজ ছিলো। বস্তুত এই ধর্মপন্থীরা এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় সামরিক বেসামরিক স্বৈরশাসকদের সমর্থন দেবার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যের পথও সুগম করেছে। ৮০ দশক থেকে ইসলামী ‘মৌলবাদী’ তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার সাথে প্রান্তস্থ দেশগুলোতে বিপন্নদশা ও সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কিত। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ৮০ দশক পর্যন্ত ধর্মপন্থী শক্তিগুলোকে সমাজতন্ত্র ও সবরকম মুক্তির লড়াই-এর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এই পর্যায়ের সর্বশেষ বড় উদাহরণ আফগানিস্তান। প্রথমে মুজাহেদীনদের মাধ্যমে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সমর্থিত সরকার উচ্ছেদ করে যুক্তরাষ্ট্র। সেইসময় আফগান মুজাহেদীনদের সবরকম পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে তারা। প্রশিক্ষণ দিয়েছে, অস্ত্র দিয়েছে, অর্থ দিয়েছে। অর্থ দিয়েছে সৌদী আরবও। ইউএসএইড সরবরাহ করেছে ইসলামী উন্মাদনা সৃষ্টির মতো বই, শিশুদের পাঠ্যপুস্তক। যার মধ্যে সোভিয়েত সৈন্যের চোখ উপড়ে ফেললে বেহেশতে যাবার প্রতিশ্রুতিও ছিলো। সিআইএ-র এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে মাঠের ভূমিকা পালন করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সামরিক শাসনের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউল হকের মতো একজনকে অধিষ্ঠিত করা সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাজে দিয়েছে। একপর্যায়ে আকস্মিকভাবে বিশাল শক্তি নিয়ে উদিত হয় তালিবান। মুজাহিদীনদের বিরুদ্ধে যাদের অস্ত্র, সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ এবং কৌশলগত সমর্থন সবই যোগান দিয়েছে সেই যুক্তরাষ্ট্রই।
তালেবানরা আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের সূচনা করে ১৯৯৭ সালের ২৪ মে। ঠিক তার আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ ব্যবসা জগতের মুখপাত্র ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল আফগানিস্তান নিয়ে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সেখানে লেখা হয়: ‘আফগানিস্তান হচ্ছে মধ্য এশিয়ার তেল, গ্যাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানির প্রধান পথ।…তাদের পছন্দ কর বা না কর ইতিহাসের এই পর্যায়ে তালিবানরাই আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবচাইতে উপযুক্ত।’ (জার্নাল, ১৯৯৭) দুদিন পর অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের ২৬ মে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস লেখে: ‘কিনটন প্রশাসন মনে করে যে, তালিবানদের বিজয় ইরানের পাল্টা শক্তি হিসেবে দাঁড়াবে..এমন একটি বাণিজ্য পথ উন্মুক্ত করবে যা এই অঞ্চলে রাশিয়া ও ইরানের প্রভাবকে দুর্বল করবে।’
অনেকে আবার এরকম ভাবে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’ পরিচালনা করছে ‘ইসলামী জঙ্গি’দের বিরুদ্ধে সেকুলার শক্তির পক্ষে। এটিও আরেকটি বড় ভ্রান্তি। বস্তুত নির্বাচিত সেকুলার সরকার উচ্ছেদে মার্কিনী রেকর্ড অনেক। ৭০ ও ৮০ দশকে আফগানিস্তানে সেকুলার সরকারই ক্ষমতায় ছিলো, কিন্তু তারা ছিলো মার্কিন বিরোধী সোভিয়েত পন্থী। এই সরকারগুলো আফগানিস্তানে ভূমি সংস্কার, নারী অধিকার, শিক্ষা ও চিকিৎসা সংস্কারে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলো। ইরাক ও লিবিয়াতেও সেকুলার সরকার ছিলো। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিশুদ্ধ পানিসহ জন অধিকারের ক্ষেত্রেও তাদের অনেক সাফল্য ছিলো। যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দাম ও গাদ্দাফীকে উচ্ছেদের পর সেসব ব্যবস্থা তছনছ হয়ে গেছে। আর সেখানে বিভিন্ন ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর প্রভাব বেড়েছে।
একইসঙ্গে গণনায় লাশের সংখ্যাও বাড়ছে। গত ২৯ মার্চ “বডি কাউন্ট: ক্যাজুয়ালটি ফিগারস আফটার টেন ইয়ারস অব দ্য ওয়ার অন টেরর” নামের এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে জার্মান, কানাডিয়ান ও মার্কিন তিনটি সংগঠন যৌথভাবে। এগুলো হলো ইন্টারন্যাশনাল ফিজিশিয়ানস ফর দ্য প্রিভেনশন অব নিউকিয়ার ওয়ার, ফিজিশিয়ানস ফর সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি, এবং ফিজিশিয়ানস ফর গ্লোবাল সারভাইভাল”। এই রিপোর্টে ২০০৪ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত পরিচালিত সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে, এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণে ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ১৩ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১০ লাখ ইরাকে, দুই লাখের বেশি আফগানিস্তানে। মার্কিন ড্রোন ও অন্যান্য আক্রমণে ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন শুধু পাকিস্তানেই। এর মধ্যে বেসামরিক নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।
মার্কিন গবেষক উইলিয়াম ব্লুম যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ভূমিকার দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষক। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বের সবচাইতে বড় দখলদার শক্তি। ১৯৪৫ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৪০টি দেশের সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করেছে, ৩০টি জনপ্রিয় জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে ধ্বংস করেছে, ২৫টি দেশে বোমা মেরে ক্ষতবিক্ষত করেছে, বহুলক্ষ মানুষ হত্যা করেছে, তার কয়েকগুণ বেশি সংখ্যক মানুষের জীবন তছনছ করেছে।’২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের নামে ইরাক দখল ও ছিন্নভিন্ন করলো। তারপর থেকে বিশ্বের বহুদেশে দখল ও হত্যাকান্ড চলছে সন্ত্রাস দমনের মুখোশে।
২০০১ এর আগে ইরাক লিবিয়া সিরিয়ায় আল কায়েদা বা তালেবান ধারার কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিলো না। তথাকথিত ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’ এই অঞ্চলকে চেনা অচেনা সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। সর্বশেষ এই অঞ্চলে বিরাট শক্তি ও সম্পদ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে আইসিস যা ইসলামী রাষ্ট্র বা খিলাফৎ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। নতুন শত শত গাড়ি, বার্ষিক ১৬ হাজার কোটি টাকার বাজেট এবং প্রায় ৩০ হাজার সশস্ত্র সদস্য নিয়ে আচমকা তারা হাজির। তারা ইরাক, সিরিয়ায় একের পর এক অঞ্চল দখল করছে। তারা একের পর এক ভিন্নধর্ম ও মতাবলম্বী, সংখ্যালঘু জাতির মানুষদের ধরছে, গলা কাটা ও নির্যাতনের দৃশ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রচার করছে। হঠাৎ করে এরকম একটি বিশাল বাহিনীর জন্ম এবং ক্রমান্বয় বিজয় আফগানিস্তানে তালিবানদের আচমকা আবির্ভাব এবং দ্রুত আফগানিস্তান দখলের কথা মনে করিয়ে দেয়।
ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ছিন্নভিন্ন হবার ফলে এই দেশগুলোর মানুষদের নারকীয় অনিশ্চিত অবস্থায় পড়তে হয়েছে। ইউরোপে অভিবাসনে বিশাল স্রোত এরই ফলাফল। অন্যদিকে এর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী তিনপক্ষ: সৌদী আরব, ইজরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তাদের কাছে ইরাকের সাদ্দামের অপরাধ স্বৈরশাসন ছিলো না ছিলো তেল ক্ষেত্র জাতীয়করণ এবং সামরিক শক্তি হিসেবে সৌদী আরব ও ইজরায়েলের কর্তৃত্ব অস্বীকারের ক্ষমতা। লিবিয়ার গাদ্দাফিরও একই অপরাধ ছিলো। সৌদী রাজতন্ত্র বরাবরই তার ওপর গোস্বা ছিলো। জীবনের শেষ পর্যায়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক গড়ার লক্ষ্যে ‘নয়া উদারতাবাদী’ বলে পরিচিত পুঁজিপন্থী কিছু সংস্কারের পথে গেলেও গাদ্দাফীর বড় অপরাধ ছিলো সৌদী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্পষ্ট আক্রমণাত্মক কথাবার্তা। ২০১১ সালে গাদ্দাফী সরকারকে উচ্ছেদ করবার জন্য ন্যাটো বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি এবং আল কায়েদাসহ বিভিন্ন ভাড়াটিয়া ইসলামপন্থীদের জড়ো করার কাজটি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশ ও সৌদী আরবের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়।
সিরিয়ার আসাদ সরকারেরও অপরাধ স্বৈরশাসন নয়, অপরাধ সৌদী আরব-ইজরাইল অক্ষের কাছে তার অগ্রহণযোগ্যতা। সিরিয়ার আসাদ সরকার উচ্ছেদের জন্য অতএব বিভিন্ন ক্ষুদ্ধ গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় পশ্চিমা শক্তি ও সৌদী-কাতার-জর্ডান রাজতন্ত্র। ইরানকে কাবু করাও এর একটি উদ্দেশ্য ছিলো। আসাদ বিরোধী এসব গোষ্ঠীর অধিকাংশই আল কায়েদা ঘরানার বিভিন্ন গ্রুপ, ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী। সৌদী আরব, কাতার, তুরস্ক, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বিপুল অর্থ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র যোগানের ওপর ভর করেই এসব গোষ্ঠী শক্তিপ্রাপ্ত হয়। এর সাথে মার্কিন, ব্রিটিশ, ফরাসি ও ইজরায়েলী গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বিত ভূমিকা ছিলো উল্লেখযোগ্য। এদেরই অনেকে এখন গঠন করেছে আইসিস। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেন কিছুদিন আগে এক বক্তৃতায় মুখ ফসকে আইসিস এর পেছনে এই দেশগুলোর শত হাজার কোটি ডলার সহ নানা পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলে ফেললেও পরে মিত্রদের ক্ষোভের মুখে মাফ চেয়েছেন। বাইডেন অবশ্য নিজেদের ভূমিকার কথা বলেননি। কিন্তু সত্য ঢাকা পড়েনি।
‘মৌলবাদ’কে একটি গ্রামীণ, অনাধুনিক, পশ্চাৎপদ বিষয় হিসেবে দেখলে এর শেকড় সন্ধান পাওযা যাবে না, এর ব্যাপ্তি বোঝানো যাবে না। মার্কিন ইসলামবিষয়ক পন্ডিত আমিনা ওয়াদুদ এর মতে ‘ইসলামপন্থীদের বর্তমান পুনরুত্থান একটি উত্তর-আধুনিক ঘটনা’। যেভাবেই বলি না কেনো, ‘মৌলবাদী’ শক্তিগুলোর ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভাবকে নিছক স্থানীয় বা জাতীয় বিষয় হিসেবে দেখা চলে না। তথ্য যুক্তি দিয়েই তারিক আলী দেখিয়েছেন যে, ‘বর্তমান সময়ে সবচাইতে বড় ‘মৌলবাদ’, ‘সকল মৌলবাদের জন্মদাতা’ হলো- মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’।
তাই এটা বিস্ময়কর নয় যে, একইসাথে ‘সন্ত্রাস বিরোধী তৎপরতা’র নামে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে, অস্ত্র যোগান বাড়ছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর হচ্ছে, নতুন নতুন দৃশ্যমান অদৃশ্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে, গোয়েন্দা সংস্থার দাপট বাড়ছে, সন্ত্রাস বাড়ছে, তা দমনে নতুন নতুন দমন পীড়নের আইন, বিধিনিষেধ তৈরি হচ্ছে। যারা সবচাইতে বড় সন্ত্রাসী তারাই বিশ্বজুড়ে দাপাচ্ছে ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’ নাম দিয়ে। বাংলাদেশ এরই অন্তর্ভুক্ত একটি অঞ্চল, যাকে বিশ্ব সন্ত্রাসের উর্বর ভূমি বানানোর চেষ্টাও খুব জোরদার বলে মনে হয়।