Nurul Amin

রাজনীতির ফাকা মাঠে ধর্মীয় মৌলবাদঃ জনগণ কে দেখে বুঝে সিন্ধান্ত নিতে হবে।

রাজনীতিহীনতার সুযোগে উগ্র, ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী শক্তি আবারও সক্রিয় হচ্ছে। এরপরও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকার চুপ করে আছে। কারণ, ধর্মীয় রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার সুবিধা এখন তারাও ভোগ করছে।

অনেকেই বলছেন, দেশে এখন কোনো রাজনীতি নেই। কেউ কেউ বলছেন, গণতন্ত্রও নেই। যেনতেন নির্বাচন দিয়ে আওয়ামী লীগ জোর করে দেশ শাসন করছে। বিএনপি আত্মহননের পথেই চলছে। জাতীয় পার্টি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করছে। জামায়াতে ইসলামী লুকিয়ে আছে। বাম দলগুলো মাঝে মাঝে রাজনীতির ব্যর্থ চেষ্টা করছে। রাজনীতিহীনতার এই সুযোগে উগ্র, ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী শক্তি আবারও সক্রিয় হচ্ছে। ডিজিটাল প্লাটফর্মে তারা খুবই সরব। মাঠে-ময়দানেও তাদের উপস্থিতি আছে। ধর্মীয় উন্মাদনাকে আবারও জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে উগ্রবাদীরা। শান্তির ধর্ম ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে অশান্তির আগুন আবারও জ্বালাতে চাইছে। ভাস্কর্যকে মূর্তি অ্যাখ্যা দিয়ে ধ্বংস করে ফেলার দাবি করছে। যাকে-তাকে কাফের, মুরতাদ, নাস্তিক ফতোয়া দিচ্ছে। কোরআন-হাদিসের শিক্ষা আর ইসলামের ইতিহাসকে বিকৃত করছে। অথচ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকার চুপ করে আছে। কারণ, ধর্মের নামে রাজনীতির সুবিধা তারাও পেয়েছে। ধর্মান্ধ শক্তিকে কাবু করার আওয়ামী কৌশল আপাত সুফল দিলেও, এর দীর্ঘমেয়াদী কুফল কাউকেই ছাড়বে না। টানা তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায়, এই দলটি হয়তো ভয়ঙ্কর সেই পরিণতির কথা ভাবছে না।

দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার শুরু ১৯৯৬ সালে। বিএনপিকে হারিয়ে ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আসতে সেই কৌশল কাজেও লাগে। সেই যে শুরু, আর শেষ হয়নি। কখনও প্রকাশ্যে, কখনও আড়ালে, কখনওবা কৌশলে চলে ধর্মের ব্যবহার। বিএনপিকে ঘায়েল করতে মৌলবাদীদেরও আস্কারা দেয় আওয়ামী লীগ। বিএনপিকে মাটিতে মিশিয়ে ফেলার পরও এই আস্কারা চলছে। যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে বিএনপি বড় হয়েছে, সেই স্বাধীনতা-বিরোধী মৌলবাদী শক্তি কখনোই আওয়ামী লীগের হবে না। বড়জোর তাদেরকে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে। সেটাই দিচ্ছে এখন। কিন্তু এই স্বস্তি কিসের বিনিময়ে? বাঙালি জাতির অস্তিত্বের বিনিময়ে? স্বাধীনতার সব অর্জনের বিনিময়ে? ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক সমাজের বিনিময়ে? আধুনিক, বৈজ্ঞানিক, জ্ঞাননির্ভর সামাজিক চেতনার বিনিময়ে? ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দিয়ে কি ডিজিটাল বাংলাদেশ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব? বঙ্গবন্ধুর শোষণহীন সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব? দুধ-কলা দিয়ে পুষলেও সাপ ছোবল দেবেই। উগ্রবাদীরা বিষধর সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উগ্র শক্তিই আজকের বিশ্বের সবচেয়ে বড় শত্রু।

ফিরে আসি দেশে রাজনীতিহীনতার প্রসঙ্গে। দুরবীন দিয়ে খুঁজতে গেলে, রাজনীতি পাওয়া যাবে টেলিভিশনের টকশো’তে। সেটা কেবলই কথার রাজনীতি, দোষারোপের রাজনীতি, অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগের রাজনীতি। অকার্যকর সংসদের এই যুগে এটাই-বা কম কিসে! গত সপ্তাহে ঢাকার একটি উপনির্বাচনের দিন রাজধানীর নয়টি জায়গায় বাসে আগুন দেওয়া হয়। সেটা নিয়েই চলছে দোষারোপের রাজনীতি। অনেক দিন পর বাসে আগুন দেখল নগরবাসী। যানবাহন আর দোকানপাট ভাঙা এবং আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া এক সময় নিয়মিত ঘটনা ছিল। হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভ ও সমাবেশের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা নিয়মিতই ঘটত। ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের টানা ৯৩ দিন অবরোধ কর্মসূচিতে ভয়াবহ ‘আগুন সন্ত্রাস’ দেখেছে এদেশের মানুষ। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের লাগাতার হরতালেও আগুন-ভাঙচুরের অনেক ঘটনা ঘটেছে। তবে এমন ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে স্বৈরাচারী এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে। টানা নয় বছরের ওই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দু’দলের কর্মসূচিতেই যান-বাহন ও দোকান-পাটে ভাঙচুর এবং আগুন লাগানো ছিল নিয়মিত ঘটনা। তখনকার বিরোধী দলগুলোর রাজনীতিকে ‘জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি’ বলতেন এরশাদ। অন্যদিকে, স্বৈরাচার হটাতে জ্বালাও-পোড়াওকে সঠিক কাজ বলেই মনে করতেন অনেকেই। যদিও স্বৈরাচারের পতনের পরও এই রাজনীতি বন্ধ হয়নি।

গত এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি ও নির্বাচন কোনোটাই দেখছে না দেশের মানুষ। সবই চলছে একতরফা। একদিকে আওয়ামী লীগ সব শক্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্ষমতায় টিকে আছে। অন্যদিকে, নেতৃত্বের সংকট, ভুল রাজনীতি আর জনবিমুখতার কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। তবে এত সব হতাশার মাঝেও সাধারণ মানুষ এক ধরনের স্বস্তিতে আছে। তারা এখন রাজনীতির আগুনে পুড়ছে না। ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতায় থাকার বীভৎস লড়াইয়ের শিকার হচ্ছে না তারা। কিছু মানুষের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণের হাতিয়ার হতে হচ্ছে না তাদের। কারা ক্ষমতায় আর কারা ক্ষমতার বাইরে, কিছু সুবিধাভোগী মানুষ ছাড়া, তাতে জনগণের কিছু যায় আসে না। তাই বলে কি দেশ রাজনীতিহীন আর গণতন্ত্রহীন থাকবে? মোটেও না। ধ্বংসাত্মক আর হিংসাত্মক রাজনীতির বিকল্প নিশ্চয় রাজনীতিহীনতা নয়। বিকল্প হচ্ছে, সুস্থ ও কল্যাণমুখী রাজনীতি।