সন্ত্রাস পৃথিবীব্যাপী পরিচিত, বহুল আলোচিত শব্দ। সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ এবং মানবতার প্রতি চরম হুমকি। রাজনৈতিক কারণে হোক বা অন্য কোন ব্যাপারে স্বার্থসিদ্ধি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করার নিমিত্তে বোমা বিস্ফোরণ, অপহরণ, ভয়-ভীতি বা গুপ্ত হত্যার মত ঘৃণ্য কাজই হলো ‘সন্ত্রাসবাদ’; যা সভ্য সমাজে সাধারণত গ্রহণযোগ্য নয়। সন্ত্রাসের কোন ধর্মীয় ভিত্তি নেই, ইসলাম ধর্মে এটি ঘৃণ্যতম কাজ। ভীতি তথা ফিতনা সৃষ্টি হত্যার চাইতেও মারাত্মক। ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ম, বর্ণ, জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে সব মানুষের প্রাণ, সম্পদ, মর্যাদা অত্যন্ত পবিত্র। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারো জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করল।’
জোর করে, শক্তি প্রয়োগ করে বা অস্ত্রের বলে ইসলামের আদর্শ কোথাও প্রচারিত হয়নি। ইসলাম টিকে আছে এবং টিকে থাকবে তার কালজয়ী আদর্শ, অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে। ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে পারস্পরিক সহ-অবস্থান, সহিষ্ণুতা, মানবিক আচরণ ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। ইসলামে সন্ত্রাসের ঠাঁই নেই, প্রকৃত মুসলমানরা কখনও সন্ত্রাস করতে পারে না। ইসলাম হচ্ছে শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম। তাই এর অনুসারীরা মানুষ হত্যা করতে পারে না, সম্পত্তি বিনষ্ট করতে পারে না। শুধু তাই নয়, কোন মুসলমান নিছক রাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে মানুষ তো দূরের কথা, অন্য কোন প্রাণীও হত্যা করতে পারে না।
নিজ ধর্মের ইমাম ও অন্য ধর্মের পুরোহিতদের হত্যা, হুমকি, বোমাবাজি, আতঙ্ক সৃষ্টি, বিদেশীদের জিম্মি বানিয়ে হত্যার মত সন্ত্রাসবাদের দূরপ্রসারী প্রভাব তো আছেই, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াও ব্যাপক। যেমন এতে বিশ্ববাসীর কাছে ইসলাম সম্পর্কে ভুল বার্তা যায়। বিদেশীরা মনে করে ইসলাম সন্ত্রাসী ধর্ম এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের ইসলাম সহ্য করতে পারে না। ইসলামের দাওয়াতী তৎপরতা বাধাগ্রস্ত করা সন্ত্রাসীদের আরেকটি উদ্দেশ্য।
নাম, টুপি-দাড়ি, হিজাব, বোরকা-জিলবাব মুসলমানদের পরিচয় ও ঐতিহ্য বহন করে। বিদেশ বিভূঁইয়ে বসবাসরত মুসলমান নারী-পুরুষ এই ঐতিহ্য লালন ও ধারণে ভীতিসন্ত্রস্ত হচ্ছেন। পথে অপদস্থ হওয়ার বহু ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটেছে।
যে দেশে বিদেশী ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও দাতাসংস্থার পরামর্শক সন্ত্রাসীদের হাতে মারা যায়, স্বাভাবিকভাকে সে দেশে বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও বিদেশী সাহায্য বাধাগ্রস্থ হয়। এতে দেশের ভাবমূর্তির মারাত্মক ক্ষতি হয়। তখন জঙ্গিদমনে সহায়তা দানের প্রস্তাব নিয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে ওঠে।অতি বিত্তশালীদের সন্তান, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে উত্তীর্ণ ও দেশ-বিদেশের নামি-দামী সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া। এখন এর কী জবাব আছে? আমরা মনে করি সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী তৎপরতার জন্য কোন বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দায়ী নয়।
কূটনৈতিকপাড়া নামে খ্যাত ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গিদের হাতে ২০জন দেশী-বিদেশী প্রাণ হারানোর ঘটনায় দেশবাসী স্তম্ভিত, বেদনাহত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। পবিত্র রামাযান মাসে নিরীহ মানুষদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড কেউ সহজে মেনে নিতে পারেননি। ইতালীর যেসব ব্যক্তি আমাদের দেশে গার্মেন্টস ব্যবসার সাথে জড়িত এবং ঢাকার মেট্রোরেলের পরামর্শক হিসেবে জাপানের যেসব প্রকৌশলী কর্মরত আমরা তাঁদের জিম্মি বানিয়ে জবাই করে দিলাম। তাঁরা তো কোন পক্ষ-বিপক্ষের লোক নয়, অপরাধী নয় বরং উন্নয়ন সহযোগী। এ হত্যাকাণ্ড কোন ধর্ম, আদর্শ, নৈতিকতা ও রাজনীতির মাপকাঠিতে পড়ে না। এর ফলে ইসলাম ও বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে ভুলবার্তা গেছে- কোন সন্দেহ নেই। পবিত্র ঈদের দিন শোলাকিয়া ঈদগাহের অনতিদূরে পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে দুজন কনস্টেবলসহ চার ব্যক্তি প্রাণ হারালেন। ঈদের দিনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম। কারা আমার দেশের কম বয়সী তরুণদের হাতে অস্ত্র দিয়ে ইসলামের চেহারা কালিমা লিপ্ত করার প্রয়াস চালাল তাদের খুঁজে বের করে আইনের হাতে সোপর্দ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাজনৈতিক দোষারোপের পুরনো খেলায় মেতে উঠলে প্রকৃত অপরাধী গা ঢাকা দেবে, নির্দোষ মানুষ শাস্তি পাবে।